শুরুতেই একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমার কথাগুলো আড্ডা, বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা বক্তৃতা ও আলোচনা, এবং পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য ও অর্জিত জ্ঞানের আলোকে উপস্থাপন করেছি। আমার কথা এবং যুক্তির বাইরেও ধর্মীয় বিশ্বাসের একটা জায়গা আছে যা উল্লেখ করা হয় নাই।
জীবনের ভার সওয়া সহজ না কঠিন তা অনেকাংশে নির্ভর করে ইচ্ছা
শক্তির উপর। ইচ্ছা শক্তির উৎস আবার অনেক, সেটা অন্য আলোচনা। আমার বক্তব্য
হল, যখন একজন মানুষ
ভাবে আমি এ ভার কেন নিব তখনই এটা ভারি প্রতীয়মান হয়। আর যখন চিন্তা
করে, মানুষ হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব এবং/বা কর্তব্য তখন ঐ বিষয়টাই অনেক হালকা হয়ে যায়। আর যখন মনে করে এটা আমিই তো করব, তখন ঐটা এতটাই হালকা হয়ে যায় যে দৈনন্দিন জীবনে তার অস্তিত্ব আর আলাদা করা যায় না। তখন আর ক্লান্ত লাগার বিষয়ই থাকে না। এখানেই জীবনের রহস্যময় সৌন্দর্য।
অনুচ্ছেদ ২: ভালবাসা ও ক্লান্তি
এটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভালবাসা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাঝে মাঝেই
আমার একে জীবনের মূল চালিকাশক্তি
বলে মনে হয়।
ভালবাসার শুন্যতা মানুষকে এমনই দুর্বল করে দেয় যে নিজের ভার বইতেই কষ্ট হয়। তবে
সামগ্রিক বিবেচনায় আমি আরও কিছু বিষয়ের সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে চাই।
প্রথমত স্বপ্ন, দ্বিতীয়ত দায়িত্ববোধ, তৃতীয়ত স্বীকৃতি এবং
পরিশেষে বৈচিত্র্য। এগুলোর প্রতিটি একজন মানুষের জীবনীশক্তি হিসেবে কাজ
করে, কখনও
কখনও জ্যামিতিক হারে প্রভাব ফেলে। এদের
মিশ্রনটা যতটা
ব্যাক্তি কেন্দ্রীক হবে,
এর প্রভাব ততটা শক্তিশালী
হবে। (জীবনের সমস্যাগুলো যেহেতু
এক প্রকার ভার, তাই তা নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না)।
অনুচ্ছেদ ৩:
সম্পর্ক, শুন্যতা ও বিস্মৃতি
কছের মানুষ বলতে আমরা আসলে আমাদের সম্পর্কগুলো কেই
বুঝাই। কিছু সম্পর্ক আমরা জন্মসূত্রে পাই যা শুধু মাত্র মৃত্যুর
মাধ্যমেই শেষ হয়। আর কিছু সম্পর্ক আমরা বেড়ে উঠার সময় অর্জন করি। যদিও এই অর্জনের অনেক নিয়ামক
থাকে, কিন্তু আমাদের নিজের বিশ্বাস আর কার্যক্রমই মূল নিয়ামক। এটা সময় ও প্রয়োজন স্বাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। আর এখানেই আমাদের
মূল করনীয়। আপনি পরিবর্তিত
সময়ের সাথে মানিয়ে নিয়ে যদি সম্পর্কগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারেন, তবেই তার বন্ধন শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এখানে কিছু মূলনীতি মেনে চলা আবশ্যক। যেমন প্রথমত সর্বাবস্থায় স্বার্থের ঊর্ধ্বে সম্পর্কের মূল্যায়ন আর মনুষ্যত্বের চর্চা। দ্বিতীয়ত, অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে যথাযথভাবে অনুধাবন ও মূল্যায়নের চেষ্টা করা।
সম্পর্ক আসলে ছেড়ে যেতে যাওয়া যায় না। যা করা যায় তা হল দুরত্ব
তৈরি করা। সেই প্রকৃয়ায় আপনি যতটা সৎ হবেন কলহ ততটাই কম হবে। আর কলহ যত কম হবে ফেরৎ আসার প্রকৃয়া তত সহজ ও দ্রুত হবে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
হচ্ছে দায়িত্ব পালন। প্রতিটা সম্পর্কেরই কিছু দাবি এবং দায়িত্ব থাকে। দুরত্ব তৈরি হলেও দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। এখানে ছাড় দিলেই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে
উঠে।
শুন্যতার বিষয়ে আমার অনুধাবন হচ্ছে এটা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেহেতু প্রতিটা মানুষ আলাদা, তাদের শুন্যতা'র ধরণও আলাদা। তবে অনুভূতি এক। এর প্রভাব ও তীব্রতা হ্রাসে আমাদের প্রয়োজন কাছের মানুষের সহচর্য যেটা আমাদের মূল সমস্যা। সুতরাং কাছের মানুষের তালিকায় জন্মসূত্রে
যাদের পেয়েছেন, তাদের বাইরে অন্যদের স্থান দেয়ায় সতর্ক হতে হবে তবে বাদ দেয়া
যাবে না। এটি করা গেলে আপনার শুন্যতা কখনও
দীর্ঘায়িত হবে না।
আর ভূলে গেলে চলবে না প্রতিটি মানুষই অসীমে মিলিয়ে যায়, ফেলে যায় কর্ম। তার প্রভাব যত বিস্তৃত, স্মৃতি তত দীর্ঘায়িত, ভাল বা মন্দ যেমনই হোক।
(মাঠঘটের বেড়ানো ও একাকিত্ব উৎযাপনের বিষয়ে
বেশি কিছু বলতে চাই না কারন এর জন্য যে আর্থ-সামাজিক পরিবেশ প্রয়োজন তা আরেকটা
আলোচনার বিষয়।)
অনুচ্ছেদ ৪: আত্মকেন্দ্রিকতা ও তার ফলাফল
আসল বিপদটা এখানেই। সম্পর্ক হচ্ছে জালের মত। এটা কখনও আপনাকে স্বাধীনতার একটা সীমারেখা টেনে দিবে কখনও আপনাকে রক্ষা করবে। আবার উল্টোও হয়। সাময়িক তৃপ্তির জন্য আমরা যখন সৃঙ্খলহীনতাকে উপভোগ করতে শুরু করি, তখনই একটি নতুন চাওয়ার সৃষ্টি হয় যা আমরা বারংবার পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি। আর এর পুনরাবৃত্তি আমাদের
কাছের মানুষের সাথে বিদ্যমান সৃঙ্খলগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। যা কিনা কাছের মানুষ গুলোকে পর্দার আড়ালে দুরে ঠেলে দেয়। ফলস্বরূপ, বাজ্যিকভাবে কাছের মানুষ গুলো প্রকৃতপক্ষে আর কাছের থাকে না। পরবর্তীতে যখন সেই কাছের মানুষের প্রয়োজন
হয় তখন অনুভব করি তারা তো আসলে কাছের মানুষ না। আর এটাই আমাদের হতাশ করে তোলে। এভাবে চক্রাকারে সবাই আরও একা হয়ে উঠি। এটা ব্যাক্তি থেকে একসময় সামাজিক
অস্থিরতায় রূপ নেয় এবং কাছের মানুষের অভাব আরও স্পষ্ট করে তুলে। এই চক্র ভাঙ্গা অনেক কঠিন। কারও কারও ক্ষেত্রে সারা জীবনেও সম্ভব হয় না। ফলস্বরূপ, তারা দ্রুতই স্মৃতির
অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়, মৃত্যুর
পরে তো অবশ্যই, আগেও!
শেষ করার আগে আমি বলতে চাই, আমরা যে সমাজব্যবস্থায় আছি তা প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তৈরি করে ছিল। এখানে ক্ষণিকের জন্য আত্মকেন্দ্রিক হওয়াটা দোষের না হলেও দীর্ঘায়িত করাটা প্রকারান্তরে উল্টো পথে হাঁটার মতই। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় এসকল অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে রাখাই শ্রেয়। Facebook এখন জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে যাওয়ায় এটি সংক্রমনের একটি মাধ্যম হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই এর ব্যবহারে আমাদের দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন আছে। যে সকল বিষয়ের অস্তিত্ব আমরা নিজের বা আমাদের কাছের মানুষের মধ্যে দেখতে চাই না, সেই সকল বিষয় Facebook এ post না করাই উত্তম। কেননা এতে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, নিজের এবং কাছের মানুষের প্রভাবিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।